নদীর বিদ্রোহ গল্পের প্রশ্ন উত্তর
নদীর বিদ্রোহ ( মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় )
ক) বহুবিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলী (MCQ) – মান ১ (৫০টি)
১. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পের প্রধান চরিত্রের নাম কী?
২. নদেরচাঁদের বয়স কত?
৩. নদেরচাঁদ কীসের চাকরি করত?
৪. কতদিন ধরে একটানা বৃষ্টি চলছিল?
৫. নদীর উপর ব্রিজের দৈর্ঘ্য কত ছিল?
৬. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে” – কারণটি কী?
৭. নদেরচাঁদকে পিষে দিয়ে কোন ট্রেন চলে গিয়েছিল?
৮. নদেরচাঁদের স্ত্রীর লেখা চিঠিটি কত পাতার ছিল?
৯. নদেরচাঁদ কত বছর ধরে স্টেশন মাস্টারি করছে?
১০. নদীর জল কী রঙের ছিল?
১১. “চিঠিটা পকেটেই ছিল” – চিঠিটি কে লিখেছিল?
১২. নদেরচাঁদ কিসের জন্য গর্ব অনুভব করত?
১৩. “ছেলেমানুষের মতো ঔৎসুক্য বোধ করিতে লাগিল” – কার সম্পর্কে বলা হয়েছে?
১৪. নদেরচাঁদ নদীর ধারে কতক্ষণ বসেছিল?
১৫. নদীর চাঁদের ‘পাগলামি’ কী ছিল?
১৬. নদীটি স্টেশন থেকে কত দূরে ছিল?
১৭. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পটি কোন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়?
১৮. নদেরচাঁদের কাছে নদী কীসের মতো ছিল?
১৯. “দেশের নদীটি ছিল…” – কেমন?
২০. নদেরচাঁদের সহকারী কী দেখে অবাক হয়েছিল?
২১. ব্রিজের এক ধার ঘেঁষে কী চলে যাওয়ার পথ ছিল?
২২. নদেরচাঁদ কী দিয়ে নদীকে মাপার চেষ্টা করছিল?
২৩. “আজ তার মনে হইল, কী সর্বনাশ!” – ‘সর্বনাশ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
২৪. নদীর চাঞ্চল্যকে নদেরচাঁদ কীসের সঙ্গে তুলনা করেছে?
২৫. নদেরচাঁদের চার বছরের চেনা নদীর মূর্তিকে সে কী করতে পারছিল না?
২৬. “নদেরচাঁদ স্তম্ভিত হইয়া গেল।” – কেন?
২৭. নদেরচাঁদের মৃত্যুর কারণ কী?
২৮. নদেরচাঁদের দেশের নদীটি এখন কী অবস্থায়?
২৯. নদেরচাঁদের কাছে কী অসহ্য বোধ হচ্ছিল?
৩০. নদেরচাঁদ কোন দিকে corriendo পালাচ্ছিল?
৩১. “নদীকে এভাবে ভালোবাসিবার একটা কৈফিয়ত নদেরচাঁদ দিতে পারে।” – কৈফিয়তটি কী?
৩২. নদেরচাঁদের মধ্যে কিসের উন্মত্ততা দেখা দিয়েছিল?
৩৩. নদেরচাঁদের নতুন সহকারী তার কোন কাজে অবাক হয়েছিল?
৩৪. নদেরচাঁদ যখন ব্রিজ পার হচ্ছিল, তখন তার থেকে ট্রেনটি কত দূরে ছিল?
৩৫. “আমি হয়তো পাগল হইয়া গিয়াছি।” – নদেরচাঁদ কেন এমন ভেবেছিল?
৩৬. নদেরচাঁদ শেষ মুহূর্তে কী করতে চেয়েছিল?
৩৭. বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস জোরালো হওয়ায় কী হচ্ছিল?
৩৮. নদীকে দেখে নদেরচাঁদের কীসের ভয় হয়েছিল?
৩৯. নদেরচাঁদ কী ছিঁড়ে নদীর জলে ফেলে দিয়েছিল?
৪০. ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নদেরচাঁদের কী ইচ্ছা করছিল?
৪১. নদেরচাঁদের খেলা কী ছিল?
৪২. নদীর জলস্তর ব্রিজের কত নিচে ছিল?
৪৩. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে কোন ঋতুর উল্লেখ আছে?
৪৪. “নিজের এই পাগলামিতে যেন আনন্দই উপভোগ করে” – পাগলামিটি কী?
৪৫. নদেরচাঁদ কখন নদীর তীরে গিয়েছিল?
৪৬. নদেরচাঁদের রোমান্টিক মন কীসের অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছিল?
৪৭. নদী কী ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলছিল?
৪৮. “লোষ্ট্রখন্ড” শব্দের অর্থ কী?
৪৯. নদেরচাঁদের কাছে ট্রেনটিকে কেমন মনে হচ্ছিল?
৫০. গল্পের শেষে নদেরচাঁদের শরীর কোথায় পড়ে রইল?
খ) অতি-সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী (SAQ) – মান ১ (৪০টি)
১. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পটি কার লেখা?
উত্তর: ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা।
২. নদেরচাঁদের পেশা কী ছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদের পেশা ছিল স্টেশন মাস্টারি।
৩. নদেরচাঁদের বয়স কত ছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদের বয়স ছিল ত্রিশ বছর।
৪. কত নম্বর ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেন নদেরচাঁদকে পিষে দিয়ে গিয়েছিল?
উত্তর: ৭ নম্বর ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেন নদেরচাঁদকে পিষে দিয়ে গিয়েছিল।
৫. নদেরচাঁদ কোন বিষয়টি কল্পনা করতে পারছিল না?
উত্তর: নদেরচাঁদ তার চার বছরের চেনা নদীর স্বাভাবিক রূপটি কল্পনা করতে পারছিল না।
৬. ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নদেরচাঁদের কী মনে হয়েছিল?
উত্তর: ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নদেরচাঁদের মনে হয়েছিল যে, নদীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে তার জীবনটাকে ক্ষয় করে দেওয়া যায়।
৭. নদেরচাঁদের দেশের নদীটির নাম কী?
উত্তর: গল্পে নদেরচাঁদের দেশের নদীটির কোনো নির্দিষ্ট নাম উল্লেখ করা হয়নি, শুধু বলা হয়েছে সেটি একটি শীর্ণকায়া নদী।
৮. নদেরচাঁদ কেন নদীকে ভালোবাসত?
উত্তর: কারণ নদেরচাঁদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নদীর ধারেই।
৯. চিঠিটি কে লিখেছিল?
উত্তর: চিঠিটি নদেরচাঁদের স্ত্রী লিখেছিল।
১০. নদীর জল কী রঙের হয়ে উঠেছিল?
উত্তর: নদীর জল পঙ্কিল অর্থাৎ ঘোলাটে কাদা-মাটি মিশ্রিত হয়ে উঠেছিল।
১১. নদেরচাঁদ কী ছিঁড়ে ফেলেছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ তার স্ত্রীর লেখা পাঁচ পাতার চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলেছিল।
১২. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে।” – কারণটি কী?
উত্তর: নদেরচাঁদের মতে, মানুষ ব্রিজ ও বাঁধ তৈরি করে নদীকে বন্দি করেছে বলেই নদী বিদ্রোহ করেছে।
১৩. নদেরচাঁদ কত বছর ধরে এই স্টেশনে কাজ করছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ চার বছর ধরে এই স্টেশনে কাজ করছিল।
১৪. বৃষ্টির ফলে নদীর জলস্তর কতটা বেড়েছিল?
উত্তর: বৃষ্টির ফলে নদীর জলস্তর ব্রিজের প্রায় কাছাকাছি উঠে এসেছিল।
১৫. নদেরচাঁদ কীসের জন্য গর্ব অনুভব করত?
উত্তর: নদেরচাঁদ তার কর্মস্থলের কাছের নদীটির জন্য গর্ব অনুভব করত।
১৬. নদেরচাঁদের ‘পাগলামি’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: মুষলধারার বৃষ্টিতে ভিজে নদীর ধারে একা একা বসে থাকাকে নদেরচাঁদের ‘পাগলামি’ বলা হয়েছে।
১৭. নদেরচাঁদ কী দিয়ে নদীকে জানার চেষ্টা করছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ তার এতদিনের অর্জিত সামান্য জ্ঞান দিয়ে নদীকে জানার চেষ্টা করছিল।
১৮. নদেরচাঁদের কাছে ট্রেনটিকে কেমন মনে হচ্ছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদের কাছে ট্রেনটিকে একটি প্রাণহীন, যান্ত্রিক বস্তু বলে মনে হচ্ছিল।
১৯. “আমি চলিলাম” – কে, কাকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলেছে?
উত্তর: নদেরচাঁদ নদীকে উদ্দেশ্য করে এই কথা বলেছে।
২০. নদেরচাঁদ স্টেশনে নতুন কী রঙ করিয়েছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ স্টেশনের ছোট ছোট ঘরগুলিতে নতুন করে রঙ করিয়েছিল।
২১. নদীকে দেখে নদেরচাঁদের কীসের কথা মনে পড়েছিল?
উত্তর: নদীকে দেখে নদেরচাঁদের তার দেশের শীর্ণকায়া নদীটির কথা মনে পড়েছিল।
২২. ‘ফেনোচ্ছ্বাস’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ‘ফেনোচ্ছ্বাস’ শব্দের অর্থ হলো ফেনার উচ্ছ্বাস বা ফেনার প্রাচুর্য।
২৩. “বড়ো ভয় করিতে লাগিল নদেরচাঁদের” – কেন ভয় করছিল?
উত্তর: নদীর উন্মত্ত, ভয়ঙ্কর রূপ দেখে নদেরচাঁদের ভয় করছিল।
২৪. চিঠিটি না পড়েই নদেরচাঁদ রেখে দিয়েছিল কেন?
উত্তর: কারণ চিঠিতে কেবল একঘেয়ে পারিবারিক কথা লেখা ছিল, যা তার ভালো লাগছিল না।
২৫. নদী কেমন শব্দ করছিল?
উত্তর: নদী অসুস্থ মানুষের গোঙানির মতো শব্দ করছিল।
২৬. কখন নদেরচাঁদের মৃত্যু হয়?
উত্তর: ৭ নম্বর ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি ব্রিজ পার হওয়ার সময় নদেরচাঁদের মৃত্যু হয়।
২৭. নদেরচাঁদ তার সহকারীকে কী বলেছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ তার সহকারীকে বলেছিল যে সে নদীর ধার থেকে একটু ঘুরে আসছে।
২৮. নদীর জল ব্রিজের থামে ধাক্কা খেয়ে কেমন হচ্ছিল?
উত্তর: নদীর জল ব্রিজের থামে ধাক্কা খেয়ে ফেনায় ফুলে উঠছিল।
২৯. নদেরচাঁদ কীসের সঙ্গে পাল্লা দিতে চেয়েছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ নদীর উন্মত্ত স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিতে চেয়েছিল।
৩০. নদেরচাঁদ কোথায় কাজ করত?
উত্তর: নদেরচাঁদ একটি ছোট স্টেশনে স্টেশন মাস্টার হিসেবে কাজ করত।
৩১. “সে শৈশবে কি দুরন্তই ছিল” – কে দুরন্ত ছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ শৈশবে দুরন্ত ছিল।
৩২. নদেরচাঁদ কোন ট্রেনটি পার করে নদীর ধারে গিয়েছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ চারটে পনেরোর প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি পার করে নদীর ধারে গিয়েছিল।
৩৩. ‘অনর্গল’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ‘অনর্গল’ শব্দের অর্থ হলো অবিরাম বা একটানা।
৩৪. নদেরচাঁদ কীসের হিসাব রাখেনি?
উত্তর: নদেরচাঁদ ট্রেন চলে যাওয়ার পর কতক্ষণ নদীর ধারে বসেছিল, তার হিসাব রাখেনি।
৩৫. নদেরচাঁদের কী ভালো লাগছিল না?
উত্তর: স্ত্রীর লেখা একঘেয়ে পারিবারিক সুখ-দুঃখের কথা তার ভালো লাগছিল না।
৩৬. নদেরচাঁদ কীসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল না?
উত্তর: নদীর ভয়ঙ্কর গর্জনের কারণে নদেরচাঁদ ট্রেনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল না।
৩৭. নদী কী ভাঙার চেষ্টা করছিল?
উত্তর: নদী তার দু’পাশের বাঁধ ভাঙার চেষ্টা করছিল।
৩৮. নদেরচাঁদের রোমান্টিক মন কীসে শুকিয়ে যাচ্ছিল?
উত্তর: কয়লা, আর মালগাড়ির হিসাব রেখে নদেরচাঁদের রোমান্টিক মন শুকিয়ে যাচ্ছিল।
৩৯. নদেরচাঁদের শরীর কীসের মতো হয়ে গিয়েছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদের শরীর অবসন্ন এবং অবশ হয়ে গিয়েছিল।
৪০. নদেরচাঁদের শেষ পর্যন্ত কীসে পরিণত হয়েছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদের শেষ পর্যন্ত নদীর বিদ্রোহের এক দুর্বল প্রতিরূপে পরিণত হয়েছিল।
গ) সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী – মান ৩ (২৫টি)
১. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে।” – বক্তা কে? নদীর বিদ্রোহের কারণ হিসেবে সে কী বুঝেছিল?
উত্তর: উক্তিটির বক্তা গল্পের প্রধান চরিত্র নদেরচাঁদ। সে বুঝেছিল যে, মানুষ ব্রিজ তৈরি করে, বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে রুদ্ধ করেছে। এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই নদী যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে এবং সবকিছু ভেঙেচুরে নিজের মুক্তির পথ তৈরি করতে চাইছে।
২. “নদীকে এভাবে ভালোবাসিবার একটা কৈফিয়ত নদেরচাঁদ দিতে পারে।” – কৈফিয়তটি কী?
উত্তর: কৈফিয়তটি হলো, নদেরচাঁদের জন্ম ও শৈশব কেটেছে নদীর ধারে। তার দেশের শীর্ণকায়া নদীটি ছিল তার খেলার সঙ্গী। তাই নদীর প্রতি তার একটি স্বাভাবিক ও গভীর ভালোবাসা রয়েছে। এই ভালোবাসা তার রক্তের সঙ্গে মিশে আছে, যা তার নতুন সহকর্মী বা অন্য কেউ বুঝতে পারে না।
৩. “নিজের এই পাগলামিতে যেন আনন্দই উপভোগ করে।” – কার, কোন পাগলামির কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: এখানে নদেরচাঁদের পাগলামির কথা বলা হয়েছে। মুষলধারায় বৃষ্টি পড়া সত্ত্বেও সে ছাতা ব্যবহার না করে ভিজে ভিজে নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকত। এই অবুঝ আচরণ এবং প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টাকেই তার ‘পাগলামি’ বলা হয়েছে, যা সে নিজেই উপভোগ করত।
৪. নদেরচাঁদের দেশের নদী এবং কর্মস্থলের নদীর মধ্যে পার্থক্য কী ছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদের দেশের নদীটি ছিল শীর্ণকায়া, দুর্বল এবং প্রায় মজে যাওয়া। বর্ষাকালে তাতে সামান্য জল আসত। অন্যদিকে, তার কর্মস্থলের নদীটি ছিল চওড়া, খরস্রোতা এবং প্রাণবন্ত। বর্ষায় তার রূপ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। এই দুই নদীর বৈপরীত্য নদেরচাঁদের মনে গভীর প্রভাব ফেলত।
৫. “বড়ো ভয় করিতে লাগিল নদেরচাঁদের।” – নদেরচাঁদের ভয়ের কারণ কী ছিল?
উত্তর: পাঁচদিন একটানা বৃষ্টির পর নদীর জলস্তর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। তার উন্মত্ত, ফুঁসে ওঠা রূপ, ভয়ঙ্কর গর্জন এবং সবকিছু ভেঙে ফেলার প্রবণতা দেখে নদেরচাঁদের ভয় করছিল। নদীর এই অপরিচিত ও ধ্বংসাত্মক রূপ তার চেনা ছিল না, তাই সে এক অজানা বিপদের আশঙ্কায় ভীত হয়ে পড়েছিল।
৬. নদেরচাঁদ তার স্ত্রীর চিঠিটি কেন ছিঁড়ে ফেলেছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ তখন নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে এক ভিন্ন মানসিক অবস্থায় ছিল। তার কাছে নদীর বিদ্রোহ এবং প্রকৃতির বিশালতাই ছিল একমাত্র সত্য। সেই মুহূর্তে তার স্ত্রীর লেখা চিঠির একঘেয়ে পারিবারিক কথা, যেমন—বিরহ, অভিমান, সংসারের খুঁটিনাটি তার কাছে তুচ্ছ ও অর্থহীন বলে মনে হয়েছিল। তাই সে বিরক্ত হয়ে চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
৭. নদেরচাঁদের ট্রেনের তলায় চাপা পড়ার ঘটনাটি সংক্ষেপে লেখো।
উত্তর: নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে নদেরচাঁদ ব্রিজের উপর দিয়ে স্টেশনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু নদীর গর্জনে সে ৭ নম্বর ডাউন প্যাসেঞ্জার ট্রেনটির হুইসেল বা শব্দ শুনতে পায়নি। যখন সে ট্রেনটিকে দেখতে পায়, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভয়ে ও আতঙ্কে সে লাইন থেকে সরতে পারেনি এবং ট্রেনের তলায় চাপা পড়ে তার মৃত্যু হয়।
৮. “আমি হয়তো পাগল হইয়া গিয়াছি।” – নদেরচাঁদের এমন মনে হওয়ার কারণ কী?
উত্তর: ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে দেখতে নদেরচাঁদ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। সে নদীর বিদ্রোহের সঙ্গে নিজের মনের বিদ্রোহকে মিলিয়ে ফেলেছিল। তার মনে হচ্ছিল, সেও নদীর মতো বাঁধনহারা হতে চায়। এই অস্বাভাবিক চিন্তাভাবনা এবং নদীর সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথনের কারণেই তার নিজেকে পাগল বলে মনে হয়েছিল।
৯. “নদেরচাঁদ স্তম্ভিত হইয়া গেল।” – নদেরচাঁদ কেন স্তম্ভিত হয়েছিল?
উত্তর: প্রতিদিনের চেনা শান্ত নদীটি পাঁচদিনের অবিরাম বৃষ্টির পর এক ভয়ঙ্কর, উন্মত্ত রূপ ধারণ করেছিল। তার জলস্তর ব্রিজের প্রায় সমান হয়ে গিয়েছিল এবং তীব্র স্রোত সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। নদীর এই অপরিচিত, রুদ্ধমূর্তি ও ধ্বংসলীলা দেখে নদেরচাঁদ হতবাক ও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।
১০. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে ট্রেন ও নদীর মধ্যে যে বৈপরীত্য দেখানো হয়েছে, তা আলোচনা করো।
উত্তর: গল্পে নদী হলো জীবন্ত, আবেগময় ও বিদ্রোহী প্রকৃতির প্রতীক। তার মধ্যে আনন্দ, বেদনা ও ক্রোধের প্রকাশ রয়েছে। অন্যদিকে, ট্রেন হলো যান্ত্রিক, প্রাণহীন ও নিয়মমাফিক সভ্যতার প্রতীক। নদী যখন আবেগে ফুঁসছে, ট্রেন তখনও নির্লিপ্তভাবে নিজের নিয়মে ছুটে চলেছে। এই দুইয়ের বৈপরীত্যের মাধ্যমে লেখক যন্ত্রসভ্যতা ও প্রকৃতির সংঘাতকে তুলে ধরেছেন।
১১. “আজ তার মনে হইল, কী সর্বনাশ!” – ‘সর্বনাশ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘সর্বনাশ’ বলতে নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট ভয়ঙ্কর বন্যা ও ধ্বংসলীলাকে বোঝানো হয়েছে। নদেরচাঁদ কল্পনা করছিল যে, নদীর এই বিদ্রোহী স্রোত যদি বাঁধ ভেঙে দেয়, তাহলে গ্রামের পর গ্রাম ভেসে যাবে, মানুষের ঘরবাড়ি, ফসল সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে। এই সম্ভাব্য ধ্বংসের কথাই তার মনে সর্বনাশ হিসেবে দেখা দিয়েছিল।
১২. নদেরচাঁদের চরিত্রটি কীভাবে ট্র্যাজিক হয়ে উঠেছে?
উত্তর: নদেরচাঁদ নদীকে গভীরভাবে ভালোবাসত। কিন্তু গল্পের শেষে সেই নদীর ভয়ঙ্কর রূপের প্রতি আবিষ্ট হয়েই সে নিজের বিপদ ডেকে আনে। নদীর গর্জনে সে ট্রেনের শব্দ শুনতে পায় না এবং সেই ট্রেনের তলায় চাপা পড়ে তার মৃত্যু হয়। প্রকৃতির প্রতি তার অতিরিক্ত ভালোবাসা ও আত্মমগ্নতাই তার悲劇িক পরিণতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা তার চরিত্রকে ট্র্যাজিক করে তুলেছে।
১৩. “সেτίও বোধ হয় এই নদীর মতোই একটা নদী ছিল।” – এই ভাবনার কারণ কী?
উত্তর: নদেরচাঁদ যখন তার স্ত্রীর কথা ভাবছিল, তখন তার মনে হচ্ছিল তার স্ত্রীও এই নদীর মতোই চঞ্চল ও আবেগময়ী। যেমন নদী কখনও শান্ত, কখনও উচ্ছল, তার স্ত্রীও তেমনই অভিমান, ভালোবাসা ইত্যাদি নানা আবেগে পূর্ণ। নদীর চাঞ্চল্যের সঙ্গে স্ত্রীর আবেগের এই সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়ার কারণেই তার এমন মনে হয়েছিল।
১৪. গল্পের শেষে নদেরচাঁদ কীসের প্রতিরূপ হয়ে উঠেছিল?
উত্তর: গল্পের শেষে নদেরচাঁদ নিজেই নদীর বিদ্রোহের এক দুর্বল প্রতিরূপে পরিণত হয়েছিল। নদীর মতোই সে বাঁধন ছিঁড়তে চেয়েছিল—তার একঘেয়ে চাকরি, পারিবারিক দায়িত্বের বাঁধন। সে নদীর উন্মত্ততার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত নদীর মতোই এক যান্ত্রিক শক্তির (ট্রেন) দ্বারা পিষ্ট হয়েছিল।
১৫. “নদেরচাঁদকে আজ নূতন সহকারীরดู করা উচিত ছিল।” – কেন এমন বলা হয়েছে?
উত্তর: নদেরচাঁদের নতুন সহকারী ছিল একজন বাস্তববাদী মানুষ। সে নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ভয় পেয়েছিল এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছিল। অন্যদিকে, নদেরচাঁদ আবেগের বশবর্তী হয়ে নদীর কাছে গিয়েছিল এবং বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল। লেখক বলতে চেয়েছেন, নদেরচাঁদ যদি তার সহকারীর মতো বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হতো, তাহলে হয়তো তার এই করুণ পরিণতি হতো না।
১৬. “ব্রিজের একপাশে দাঁড়াইয়া সে অনেকক্ষণ সময় কাটাইয়া দিল।” – নদেরচাঁদ সেখানে দাঁড়িয়ে কী করছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ সেখানে দাঁড়িয়ে নদীর ভয়ঙ্কর, উন্মত্ত রূপ দেখছিল। সে দেখছিল কীভাবে ফেনা-মিশ্রিত ঘোলা জল তীব্র বেগে ছুটে চলেছে, ব্রিজের থামে ধাক্কা খাচ্ছে এবং সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে নদীর এই বিদ্রোহকে অনুভব করার চেষ্টা করছিল এবং প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করছিল।
১৭. “মানুষ কি তাকে রেহাই দিয়াছে?” – কে, কাকে রেহাই দেয়নি?
উত্তর: এখানে মানুষ নদীকে রেহাই দেয়নি। নদেরচাঁদের মনে হয়েছে, মানুষ তার প্রয়োজনে নদীর উপর ব্রিজ তৈরি করেছে, বাঁধ দিয়ে তার স্বাভাবিক গতিকে বাধা দিয়েছে। এভাবেই মানুষ নদীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে এবং তার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে।
১৮. নদেরচাঁদের রোমান্টিক মনের পরিচয় দাও।
উত্তর: নদেরচাঁদ একজন প্রকৃতিপ্রেমী ও রোমান্টিক মনের মানুষ। সে নদীর সঙ্গে একাত্ম বোধ করে, তার মধ্যে मानवीय আবেগ খুঁজে পায়। বৃষ্টিতে ভেজা, নদীর সঙ্গে কথা বলা, তার চাঞ্চল্যকে স্ত্রীর সঙ্গে তুলনা করা—এসবই তার রোমান্টিক মনের পরিচয় দেয়। তার এই মন যান্ত্রিক সভ্যতার একঘেয়েমি থেকে মুক্তি খুঁজছিল।
১৯. “নদীর দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াই নদেরচাঁদ স্তম্ভিত হইয়া গেল।” – সে কী দেখেছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ দেখেছিল যে, নদীর জলস্তর অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে ব্রিজের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। নদীর শান্ত রূপের বদলে সে দেখেছিল এক উন্মত্ত, ফুঁসতে থাকা স্রোত, যা তীব্র গর্জনে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। জলের রঙ পঙ্কিল হয়ে গেছে এবং চারদিকে এক ধ্বংসাত্মক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
২০. নদেরচাঁদ কীভাবে নদীকে অনুভব করতে চেয়েছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদ শুধুমাত্র চোখ দিয়ে নদীকে দেখতে চায়নি, সে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে নদীকে অনুভব করতে চেয়েছিল। সে নদীর গর্জন শুনতে, তার জলের স্পর্শ পেতে এবং তার বিদ্রোহের সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছিল। তাই সে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নদীর উন্মত্ততার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিল।
২১. “একটি সংকীর্ণ ক্ষীণ স্রোতধারা…” – কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি?
উত্তর: নদেরচাঁদের দেশের বাড়ির পাশের নদীটির বর্ণনা প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে। সেই নদীটি ছিল একটি সংকীর্ণ ও ক্ষীণ স্রোতযুক্ত ধারা। বর্ষাকালে সামান্য জল বাড়লেও বছরের অন্য সময় তা প্রায় শুকিয়ে থাকত। এই দুর্বল নদীর স্মৃতি তার বর্তমান কর্মস্থলের খরস্রোতা নদীর ঠিক বিপরীত ছিল।
২২. নদেরচাঁদের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল?
উত্তর: নদেরচাঁদের মানসিক অবস্থা ছিল জটিল ও দ্বিধাগ্রস্ত। একদিকে সে ছিল একজন দায়িত্বশীল স্টেশন মাস্টার, অন্যদিকে একজন প্রকৃতিপ্রেমী রোমান্টিক মানুষ। গল্পের শেষে নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে সে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলে এবং এক ধরনের আত্মমগ্ন, উন্মত্ত অবস্থায় পৌঁছে যায়, যা তার মৃত্যুর কারণ হয়।
২৩. “নদেরচাঁদের ভারী আমোদ বোধ হইতে লাগিল।” – কীসে আমোদ হচ্ছিল?
উত্তর: নদীর জলস্তর যখন ব্রিজের কাছাকাছি চলে এসেছিল, তখন নদেরচাঁদ একটি মাটির ঢেলা নিয়ে জলে ফেলে দেয়। ঢেলাটি স্রোতের টানে মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। নদীর এই 엄청 শক্তি ও গতি দেখে নদেরচাঁদের ভারী আমোদ হচ্ছিল।
২৪. গল্পের শেষে প্রকৃতি ও যন্ত্রের দ্বন্দ্বে কার জয় দেখানো হয়েছে?
উত্তর: গল্পের শেষে আপাতদৃষ্টিতে যন্ত্রের জয় দেখানো হয়েছে, কারণ ট্রেন নদেরচাঁদকে পিষে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু প্রতীকী অর্থে, প্রকৃতির (নদী) প্রতি ভালোবাসা এবং যন্ত্রসভ্যতার প্রতি বিতৃষ্ণাই নদেরচাঁদকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাই এই জয়-পরাজয়ের বিষয়টি জটিল এবং পাঠকের ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীল।
২৫. “আমি চলিলাম হে” – এই উক্তির মধ্যে দিয়ে নদেরচাঁদের কোন মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে?
উত্তর: এই উক্তির মধ্যে দিয়ে নদেরচাঁদের এক ধরনের উদাসীনতা ও বিচ্ছিন্নতার মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। সে যখন নদীকে বিদায় জানাচ্ছিল, তখন সে আসলে তার একঘেয়ে জীবন, পারিবারিক দায়িত্ব—সবকিছু থেকেই মুক্তি চাইছিল। এটি ছিল তার অবচেতন মনের এক পলায়নবাদী ইচ্ছা।
ঘ) রচনাধর্মী প্রশ্নাবলী – মান ৫ (১০টি)
১. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পের নামকরণ কতখানি সার্থক হয়েছে, তা আলোচনা করো।
উত্তর:
ভূমিকা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পটির নামকরণ অত্যন্ত ব্যঞ্জনাধর্মী ও সুচিন্তিত। এটি গল্পের মূল ভাব ও বিষয়বস্তুকে সার্থকভাবে ধারণ করেছে।
আক্ষরিক অর্থে বিদ্রোহ: গল্পের প্রেক্ষাপট হলো পাঁচ দিনের অবিরাম বর্ষণ, যার ফলে নদী ফুঁসে উঠেছে। তার জলস্তর বেড়ে গেছে, স্রোত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে এবং সে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। এটি হলো নদীর আক্ষরিক বা প্রাকৃতিক বিদ্রোহ।
প্রতীকী অর্থে বিদ্রোহ: গল্পের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, এই বিদ্রোহ শুধু নদীর নয়, এটি যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে প্রকৃতির বিদ্রোহ। মানুষ ব্রিজ ও বাঁধ তৈরি করে নদীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে, তার স্বাভাবিক গতিকে রুদ্ধ করেছে। নদী যেন সেই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
নদেরচাঁদের বিদ্রোহ: নদীর এই বিদ্রোহের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে গল্পের নায়ক নদেরচাঁদের মানসিক বিদ্রোহ। তার একঘেয়ে স্টেশন মাস্টারের জীবন, পারিবারিক দায়িত্বের বাঁধন—এই সবকিছু থেকে সে মুক্তি চেয়েছিল। নদীর উন্মত্ততার মধ্যে সে নিজের মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল।
উপসংহার: সুতরাং, ‘নদীর বিদ্রোহ’ নামকরণটি কেবল প্রকৃতির বিদ্রোহকে বোঝায় না, এটি মানবমনের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষারও প্রতীক। এই বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনার কারণেই নামকরণটি সর্বাংশে সার্থক।
২. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্প অবলম্বনে নদেরচাঁদ চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।
উত্তর:
ভূমিকা: ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নদেরচাঁদ একজন ত্রিশ বছর বয়সী স্টেশন মাস্টার। তার চরিত্রটি প্রকৃতিপ্রেম ও যান্ত্রিক জীবনের দ্বন্দ্বে দীর্ণ এক ট্র্যাজিক সত্তা।
১. প্রকৃতিপ্রেমী ও রোমান্টিক: নদেরচাঁদের সবচেয়ে বড় পরিচয় সে একজন গভীর প্রকৃতিপ্রেমী। নদীর প্রতি তার ভালোবাসা প্রায় আবেশের পর্যায়ে পৌঁছেছে। সে নদীর সঙ্গে কথা বলে, তার মধ্যে मानवीय আবেগ খুঁজে পায় এবং তার উন্মত্ততায় নিজেও উন্মত্ত হয়ে ওঠে।
২. দায়িত্বশীল কিন্তু অতৃপ্ত: পেশাগত জীবনে সে একজন দায়িত্বশীল স্টেশন মাস্টার। কিন্তু এই যান্ত্রিক ও একঘেয়ে জীবন তার রোমান্টিক মনকে তৃপ্তি দিতে পারে না। কয়লা ও মালগাড়ির হিসাব তার শিল্পীসত্তাকে শুকিয়ে দিচ্ছিল।
৩. আত্মমগ্ন ও কল্পনাপ্রবণ: নদেরচাঁদ অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ। সে নদীকে একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে কল্পনা করে এবং তার বিদ্রোহের কারণ বিশ্লেষণ করে। এই কল্পনাপ্রবণতা ও আত্মমগ্নতাই তাকে বাস্তব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
৪. ট্র্যাজিক পরিণতি: প্রকৃতির প্রতি তার এই তীব্র ভালোবাসা এবং বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াই তার悲劇িক পরিণতির কারণ হয়। সে নদীর বিদ্রোহের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে পড়ে যে, ধেয়ে আসা ট্রেনের বিপদ সম্পর্কে সে উদাসীন থাকে এবং মৃত্যুবরণ করে।
উপসংহার: নদেরচাঁদ চরিত্রটি আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার চাপে পিষ্ট এক সংবেদনশীল মনের প্রতিচ্ছবি, যে প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয় খুঁজেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রকৃতির আবেশেই হারিয়ে গেল।
৩. “নদীর বিদ্রোহের কারণ সে বুঝিতে পারিয়াছে।” – নদীর বিদ্রোহের কারণ হিসেবে নদেরচাঁদ কী বুঝেছিল? তার এই উপলব্ধি গল্পের শেষে কীভাবে তার পরিণতির কারণ হলো?
উত্তর:
বিদ্রোহের কারণ: নদেরচাঁদের মতে, নদীর বিদ্রোহের মূল কারণ হলো মানুষের তৈরি করা কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে ও অহংকারে নদীর উপর ব্রিজ তৈরি করেছে, দুই তীরে বাঁধ দিয়ে তার স্বাভাবিক গতিপথকে সংকুচিত করেছে। নদী যেন এই বন্দিদশা সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। সে তার শক্তি দিয়ে এই বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে নিজের মুক্তির পথ তৈরি করতে চাইছে। এই উপলব্ধিটি ছিল প্রকৃতির উপর মানুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক সংবেদনশীল মনের প্রতিক্রিয়া।
পরিণতির কারণ: নদেরচাঁদের এই উপলব্ধি তাকে নদীর সঙ্গে মানসিকভাবে একাত্ম করে ফেলেছিল। সে নদীর বিদ্রোহকে নিজের বিদ্রোহ বলে মনে করতে শুরু করে। সেও তার একঘেয়ে চাকরি, পারিবারিক দায়িত্বের বাঁধন থেকে মুক্তি চাইছিল। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে সে নদীর উন্মত্ত স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কথা ভাবে, যা ছিল এক ধরনের আত্মহত্যার সামিল। নদীর প্রতি এই তীব্র আবেশ এবং বাস্তব জগৎ সম্পর্কে উদাসীনতা তাকে এতটাই আত্মমগ্ন করে তুলেছিল যে, সে ধেয়ে আসা ট্রেনের শব্দ শুনতে পায়নি। এভাবেই, নদীর বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে তার গভীর উপলব্ধিই তাকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
৪. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে মানুষ ও প্রকৃতির সংঘাত কীভাবে ফুটে উঠেছে? এই সংঘাতে কার জয় হয়েছে বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর:
সংঘাতের স্বরূপ: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে মানুষ ও প্রকৃতির সংঘাত একটি কেন্দ্রীয় বিষয়।
১. মানুষের আধিপত্য: মানুষ তার জ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। গল্পের ব্রিজ এবং বাঁধ হলো এই নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। মানুষ নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে রুদ্ধ করে নিজের সুবিধা মতো তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে।
২. প্রকৃতির প্রতিবাদ: প্রকৃতিও এই আধিপত্য সহজে মেনে নেয়নি। পাঁচদিনের একটানা বৃষ্টি এবং তার ফলে নদীর ভয়ঙ্কর, বিদ্রোহী রূপ হলো প্রকৃতির প্রতিবাদ। নদী তার प्रचंड শক্তি দিয়ে মানুষের তৈরি করা সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ভেঙে ফেলতে চাইছে।
৩. নদেরচাঁদের ভূমিকা: নদেরচাঁদ এই সংঘাতের মধ্যে একজন দর্শক এবং অবশেষে শিকার। সে মানুষের প্রতিনিধি হয়েও প্রকৃতির পক্ষ নেয় এবং প্রকৃতির বিদ্রোহের সঙ্গে একাত্ম বোধ করে।
জয়ের প্রশ্ন: আপাতদৃষ্টিতে গল্পের শেষে যন্ত্রের (ট্রেন) জয় হয়েছে, কারণ তা নদেরচাঁদকে পিষে দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, এই জয় চূড়ান্ত নয়। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিয়েছে নদেরচাঁদের মাধ্যমে, যে ছিল মানুষ ও প্রকৃতির সংযোগ স্থাপনকারী। নদেরচাঁদের মৃত্যু প্রমাণ করে যে, প্রকৃতির আবেগকে অস্বীকার করে যান্ত্রিকভাবে তাকে শাসন করার চেষ্টা করলে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। তাই এই সংঘাতে কোনো পক্ষেরই প্রকৃত জয় হয়নি, বরং উভয়ের মধ্যেকার ভারসাম্যহীনতার করুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে।
৫. “বড়ো ভয় করিতে লাগিল নদেরচাঁদের” – নদেরচাঁদের ভয়ের কারণ ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর:
ভূমিকা: ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদেরচাঁদের ভয় একটি জটিল মানসিক অনুভূতি, যা কেবল শারীরিক বিপদের আশঙ্কা থেকে জন্মায়নি।
ভয়ের কারণ:
১. নদীর অপরিচিত রূপ: নদেরচাঁদ চার বছর ধরে যে নদীকে চেনে, তা ছিল শান্ত ও পরিচিত। কিন্তু পাঁচদিনের বৃষ্টিতে সেই নদী এক উন্মত্ত, ভয়ঙ্কর ও অপরিচিত রূপ ধারণ করেছে। প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তি ও অচেনা রূপই তার ভয়ের প্রাথমিক কারণ।
২. ধ্বংসের আশঙ্কা: নদীর এই বিদ্রোহী রূপ দেখে তার মনে হয়েছে, এই স্রোত হয়তো বাঁধ ভেঙে গ্রামকে গ্রাম ভাসিয়ে দেবে। এই সম্ভাব্য ধ্বংসলীলার কল্পনা তাকে ভীত করে তুলেছে।
৩. আত্ম-আবিষ্কারের ভয়: সবচেয়ে গভীর ভয়টি ছিল তার নিজের ভেতরের। নদীর উন্মত্ততার মধ্যে সে নিজের ভেতরের চাপা পড়া বিদ্রোহ ও আবেগকে খুঁজে পেয়েছিল। নিজের ভেতরের এই অনিয়ন্ত্রিত সত্তার মুখোমুখি হয়ে সে ভয় পেয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল, সে ক্রমশ বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
ভয়ের স্বরূপ: নদেরচাঁদের ভয় কেবল বাহ্যিক নয়, এটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক। এটি প্রকৃতির বিশালতার সামনে দাঁড়িয়ে একজন ক্ষুদ্র মানুষের অস্তিত্বের সংকট থেকে জাত ভয়। সে নদীর শক্তিকে ভয় পেয়েছে, আবার সেই শক্তির প্রতি এক তীব্র আকর্ষণও অনুভব করেছে। এই ভয় ও আকর্ষণের দ্বন্দ্বই তার চরিত্রকে জটিল ও ট্র্যাজিক করে তুলেছে।
৬. “আজ তার মনে হইল, কী সর্বনাশ! নদীর convexity যে রূপ ধারণ করিয়াছে…” – নদেরচাঁদের এই উপলব্ধির প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর:
প্রেক্ষাপট: পাঁচদিন অবিরাম বৃষ্টির পর নদেরচাঁদ যখন নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ায়, তখন সে নদীর এক অভূতপূর্ব ও ভয়ঙ্কর রূপ দেখতে পায়। জলস্তর ব্রিজের কাছাকাছি চলে এসেছে, স্রোত তীব্র এবং তার গর্জন শোনা যাচ্ছে। নদীর এই রুদ্রমূর্তি দেখে তার মনে এই সর্বনাশের আশঙ্কা জেগে ওঠে।
উপলব্ধি: নদেরচাঁদ উপলব্ধি করে যে, নদী যদি তার এই ভয়ঙ্কর রূপ বজায় রাখে, তাহলে সে তার দুই তীরের বাঁধ ভেঙে ফেলবে। এই বাঁধ ভেঙে গেলে আশেপাশের গ্রাম, জনপদ, শস্যক্ষেত্র—সবকিছু ভেসে যাবে। এক ভয়াবহ বন্যা ও ধ্বংসলীলা ঘটবে। প্রকৃতির এই রুদ্রশক্তির সামনে মানুষের অসহায়ত্ব এবং তার নিজের হাতে গড়া সভ্যতার দুর্বলতা সে প্রত্যক্ষ করে।
তাৎপর্য: এই উপলব্ধির তাৎপর্য গভীর। এটি শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা নয়। এটি প্রকৃতির উপর মানুষের আধিপত্যের অসারতাকে প্রমাণ করে। নদেরচাঁদ বুঝতে পারে যে, মানুষ যতই ব্রিজ বা বাঁধ তৈরি করুক না কেন, প্রকৃতির আসল শক্তির কাছে তা তুচ্ছ। এই উপলব্ধি তাকে প্রকৃতির বিশালতার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এবং গল্পের মূল সংঘাতকে (মানুষ বনাম প্রকৃতি) তীব্রতর করে।
৭. “ব্রিজের একপাশে দাঁড়াইয়া সে অনেকক্ষণ সময় কাটাইয়া দিল” – এই সময়কালে নদেরচাঁদের মানসিক অবস্থার বর্ণনা দাও।
উত্তর:
ভূমিকা: ব্রিজের উপর কাটানো সময়টুকু নদেরচাঁদের জীবনের এক поворотный মুহূর্ত। এই সময় তার মানসিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল ও আলোড়িত।
মানসিক অবস্থার বর্ণনা:
১. বিস্ময় ও ভয়: প্রথমে সে নদীর ভয়ঙ্কর রূপ দেখে বিস্মিত ও ভীত হয়ে পড়ে। নদীর এই অচেনা রূপ তাকে স্তম্ভিত করে দেয়।
২. একাত্মতা ও আবেশ: ধীরে ধীরে তার ভয় কেটে গিয়ে এক ধরনের আবেশ তৈরি হয়। সে নদীর গর্জনের সঙ্গে, তার উন্মত্ততার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলে। তার মনে হয়, সেও যেন নদীর মতো বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
৩. বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্নতা: এই সময়ে নদেরচাঁদ বাস্তব জগৎ থেকে প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তার স্ত্রীর লেখা চিঠি, তার চাকরি, তার চারপাশের জগৎ—সবকিছু তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। নদীর বিদ্রোহই তার কাছে একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে।
৪. আত্মহননের ইচ্ছা: তার মনে এক অদ্ভুত উন্মত্ততা জাগে। সে নদীর স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে গিয়ে জীবনকে ক্ষয় করে দেওয়ার কথা ভাবে, যা এক ধরনের পরোক্ষ আত্মহত্যার ইচ্ছা।
উপসংহার: এই সময়কালে নদেরচাঁদ একজন সাধারণ স্টেশন মাস্টার থেকে এক ভাবুক, দার্শনিক এবং অবশেষে প্রকৃতির হাতে আত্মাহুতি দেওয়া এক ট্র্যাজিক চরিত্রে রূপান্তরিত হয়।
৮. ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা ও আদিম প্রকৃতির মধ্যে যে সংঘাত দেখানো হয়েছে, তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর:
ভূমিকা: ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পটি আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা এবং আদিম, অকৃত্রিম প্রকৃতির মধ্যেকার চিরন্তন সংঘাতের এক সার্থক রূপায়ণ।
যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক: গল্পে ট্রেন, ব্রিজ এবং স্টেশন হলো যান্ত্রিক সভ্যতার প্রতীক। এগুলি নিয়মমাফিক, প্রাণহীন এবং আবেগবর্জিত। ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে আসে এবং যায়, তার কোনো অনুভূতি নেই। ব্রিজ নদীর গতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মানুষের তৈরি এক যান্ত্রিক কাঠামো।
প্রকৃতির প্রতীক: অন্যদিকে, নদী হলো আদিম, জীবন্ত ও আবেগময় প্রকৃতির প্রতীক। তার মধ্যে রাগ, ক্ষোভ, আনন্দ ও বিদ্রোহের প্রকাশ ঘটে। সে কোনো নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা থাকতে চায় না। যখন মানুষ তাকে বাঁধতে চায়, তখন সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
সংঘাতের প্রকাশ: এই সংঘাত গল্পের শেষে চূড়ান্ত রূপ নেয়। নদেরচাঁদ, যে প্রকৃতির প্রতি সহানুভূতিশীল, সে যান্ত্রিক সভ্যতার প্রতীক ট্রেনের দ্বারা পিষ্ট হয়। এটি যেন প্রকৃতির উপর যন্ত্রের এক নির্মম বিজয়। কিন্তু এর মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন যে, যে মানুষ প্রকৃতির আবেগ বোঝে না, যন্ত্রের মতো নির্লিপ্ত থাকে, সে প্রকৃতির রোষানল থেকে বাঁচতে পারে না। নদেরচাঁদের মৃত্যু এই সংঘাতের এক করুণ পরিণতি।
উপসংহার: গল্পটি আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, প্রকৃতির আবেগ ও শক্তিকে সম্মান না করে কেবল যান্ত্রিক উন্নতি চূড়ান্ত ধ্বংস ডেকে আনতে পারে।
৯. নদেরচাঁদ চরিত্রটির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করো।
উত্তর:
ভূমিকা: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একজন মনস্তাত্ত্বিক লেখক এবং ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদেরচাঁদের চরিত্রটি তার এক অনবদ্য সৃষ্টি। নদেরচাঁদের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে তার ভেতরের জটিলতা ও দ্বন্দ্ব ফুটে ওঠে।
১. বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation): নদেরচাঁদ তার কর্মস্থল ও যান্ত্রিক জীবনে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। তার স্টেশন মাস্টারের একঘেয়ে কাজ, কয়লার হিসাব রাখা—এসব তার রোমান্টিক মনকে তৃপ্তি দিতে পারে না। এই বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকেই সে প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয় খোঁজে।
২. প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা (Identification with Nature): সে নদীর মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। নদীর বন্দিদশাকে সে নিজের জীবনের বন্দিদশার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে। নদীর বিদ্রোহকে সে নিজের মনের বিদ্রোহ হিসেবে দেখে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘Identification’ বা একাত্মীকরণ বলা যেতে পারে।
৩. মৃত্যু-কামনা (Death Wish): গল্পের শেষে নদেরচাঁদের আচরণে এক ধরনের মৃত্যু-কামনা বা ‘Death Wish’ লক্ষ্য করা যায়। নদীর স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবনকে ক্ষয় করে দেওয়ার চিন্তা এবং বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা—এই সবই তার অবচেতন মনের মৃত্যু-কামনার প্রকাশ।
৪. বাস্তবতা থেকে পলায়ন (Escapism): নদেরচাঁদ তার বাস্তব জীবনের সমস্যা ও একঘেয়েমি থেকে পালাতে চায়। স্ত্রীর লেখা চিঠি ছিঁড়ে ফেলা এই পলায়নবাদী মানসিকতারই প্রতীক। সে কল্পনার জগতে আশ্রয় নিয়ে বাস্তবকে অস্বীকার করতে চায়।
উপসংহার: নদেরচাঁদের চরিত্রটি আধুনিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের এক সার্থক উদাহরণ, যে যান্ত্রিকতার চাপে পিষ্ট হয়ে প্রকৃতির মধ্যে আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে আত্মহননের পথে এগিয়ে যায়।
১০. গল্পের শেষে নদেরচাঁদের মৃত্যু কি শুধুই একটি দুর্ঘটনা, নাকি এর কোনো প্রতীকী তাৎপর্য আছে? আলোচনা করো।
উত্তর:
ভূমিকা: ‘নদীর বিদ্রোহ’ গল্পে নদেরচাঁদের মৃত্যু আপাতদৃষ্টিতে একটি দুর্ঘটনা মনে হলেও, এর গভীরে এক profound প্রতীকী তাৎপর্য লুকিয়ে আছে।
দুর্ঘটনা হিসেবে: বাহ্যিকভাবে, এটি একটি দুর্ঘটনা। নদেরচাঁদ নদীর গর্জনে এতটাই মগ্ন ছিল যে, সে ট্রেনের শব্দ শুনতে পায়নি। ফলে সে সময়মতো লাইন থেকে সরতে না পেরে ট্রেনের তলায় চাপা পড়ে। এটি একটি কার্যকারণ সম্পর্কযুক্ত ঘটনা।
প্রতীকী তাৎপর্য:
১. প্রকৃতি ও যন্ত্রের সংঘাতের পরিণতি: নদেরচাঁদ ছিল প্রকৃতি (নদী) এবং যন্ত্র (ট্রেন)-এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক সত্তা। তার মৃত্যু এই দুই শক্তির সংঘাতের করুণ পরিণতিকে প্রতীকায়িত করে। যে মানুষ প্রকৃতির আবেগ ও যন্ত্রের নির্লিপ্ততার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে পারে না, তার ধ্বংস অনিবার্য।
২. রোমান্টিকতার পরাজয়: নদেরচাঁদের রোমান্টিক ও ভাবপ্রবণ মন কঠোর, যান্ত্রিক বাস্তবতার কাছে পরাজিত হয়েছে। ট্রেন এখানে সেই নির্মম বাস্তবতার প্রতীক, যা কোনো আবেগ বা অনুভূতির মূল্য দেয় না।
৩. বিদ্রোহের আত্মাহুতি: নদেরচাঁদ নিজেও নদীর মতো বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তার মৃত্যু যেন সেই বিদ্রোহের চূড়ান্ত আত্মাহুতি। সে নদীর মতোই যন্ত্রের দ্বারা পিষ্ট হয়েছে, যা দেখায় যে, আবেগময় বিদ্রোহ যান্ত্রিক শক্তির কাছে অসহায়।
উপসংহার: সুতরাং, নদেরচাঁদের মৃত্যু কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি আধুনিক সভ্যতায় মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ, প্রকৃতি ও যন্ত্রের সংঘাত এবং রোমান্টিক আদর্শের পরাজয়ের এক গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনা বহন করে।
Class 10 bengali নদীর বিদ্রোহ question answer
নদীর বিদ্রোহ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গল্পের প্রশ্ন উত্তর, MCQ, অতি-সংক্ষিপ্ত, ও রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর : Class 10 bengali নদীর বিদ্রোহ গল্পের প্রশ্ন উত্তর