আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি কবিতার প্রশ্ন উত্তর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ( শঙ্খ ঘোষ )
ক) বহুবিকল্পভিত্তিক প্রশ্নাবলী (MCQ) – মান ১ (৫০টি)
১. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটির কবি কে?
২. কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে?
৩. “আমাদের ডান পাশে…” – কী আছে?
৪. “আমাদের বাঁয়ে…” – কী?
৫. আমাদের মাথায় কী?
৬. ‘বোমারু’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
৭. “আমাদের পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ” – ‘হিমানীর বাঁধ’ কীসের প্রতীক?
৮. আমাদের কী উড়ে গেছে?
৯. কাছে-দূরে কী ছড়ানো রয়েছে?
১০. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ – পঙক্তিটি কবিতায় কতবার ব্যবহৃত হয়েছে?
১১. আমাদের কী নেই?
১২. “আমাদের ইতিহাস নেই” – কারণ কী?
১৩. আমাদের চোখ-মুখ কীসে ঢাকা?
১৪. “পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে / পৃথিবী হয়তো গেছে মরে” – এই পঙক্তিটি কী প্রকাশ করে?
১৫. কবি কীভাবে থাকতে বলেছেন?
১৬. ‘ধস’ শব্দটি কিসের প্রতীক?
১৭. ‘গিরিখাদ’ কীসের প্রতীক?
১৮. ‘আমাদের’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে?
১৯. “আমরাও তবে এইভাবে/এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?” – এই উক্তিতে কী প্রকাশ পেয়েছে?
২০. কবি কী ফিরে পাওয়ার কথা বলেছেন?
২১. “আমাদের পথ নেই আর” – এই কথা বলার কারণ কী?
২২. ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকার অর্থ কী?
২৩. “শিশুদের শব” – কথাটি কীসের প্রতীক?
২৪. “আমরা ভিখারি” – কত মাস?
২৫. ‘ভিখারি’ শব্দটি দ্বারা কবি কী বুঝিয়েছেন?
২৬. “আমাদের কথা কে-বা জানে” – এই লাইনটি কী প্রকাশ করে?
২৭. কবি কীভাবে ফিরে আসার কথা বলেছেন?
২৮. কবিতায় কোন ঋতুর ইঙ্গিত আছে?
২৯. কবি আমাদের কী করতে বলেছেন?
৩০. শঙ্খ ঘোষ কোন ছদ্মনামে লিখতেন?
৩১. “আমাদের পথ নেই কোনো” – এই লাইনটির পর কোন লাইনটি আছে?
৩২. কবিতাটির মূল সুর কী?
৩৩. “চিমনির” উল্লেখ কোন কবিতায় আছে?
৩৪. “আমাদের কী দেখার কথা ছিল?” – এই প্রশ্নটি কবিতায় কীভাবে উত্তর দেওয়া হয়েছে?
৩৫. ‘ শব’ শব্দটির অর্থ কী?
৩৬. “আমরা ফিরেছি দোরে দোরে” – কেন?
৩৭. কবি কিসের কথা জানতে চেয়েছেন?
৩৮. কবিতাটিতে ‘হাতে হাত রাখা’ কীসের প্রতীক?
৩৯. “পৃথিবী” সম্পর্কে কবির কী ধারণা?
৪০. “হয়তো” শব্দটি কবিতায় কী প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয়েছে?
৪১. “আমাদের পথ নেই আর” – পঙক্তিটির ‘আর’ শব্দটি কী বোঝাতে ব্যবহৃত?
৪২. ‘হিমানী’ শব্দের অর্থ কী?
৪৩. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ – এই আহ্বান কার প্রতি?
৪৪. কবিতায় কোন শব্দটি অনুপস্থিত?
৪৫. “আমরা” শব্দটি কবিতায় কতবার ব্যবহৃত হয়েছে?
৪৬. “চোখমুখ ঢাকা” – এই চিত্রকল্পটি কী বোঝায়?
৪৭. কবিতার শেষে কবি কোন বিষয়ে ইতিবাচক?
৪৮. কোন পঙক্তিতে সরাসরি মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে?
৪৯. কবি কাদেরকে ‘ভিখারি’ বলেছেন?
৫০. “আমাদের কথা কে-বা জানে” – এখানে ‘কথা’ শব্দের অর্থ কী?
খ) অতি-সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী (SAQ) – মান ১ (৪০টি)
১. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত?
উত্তর: কবিতাটি ‘জলই পাষাণ হয়ে আছে’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।
২. আমাদের ডান পাশে কী?
উত্তর: আমাদের ডান পাশে ধস।
৩. আমাদের বাঁয়ে কী?
উত্তর: আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ।
৪. মাথায় বোমারু থাকার অর্থ কী?
উত্তর: মাথায় বোমারু থাকার অর্থ হলো মাথার উপর যুদ্ধবিমান উড়ছে, অর্থাৎ যুদ্ধের আশঙ্কা রয়েছে।
৫. ‘হিমানীর বাঁধ’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর: ‘হিমানীর বাঁধ’ বলতে কবি অগ্রগতির পথে জমাট বাঁধা প্রতিবন্ধকতা বা স্থবিরতাকে বুঝিয়েছেন।
৬. কাদের ঘর উড়ে গেছে?
উত্তর: বিপন্ন, অসহায় সাধারণ মানুষদের (‘আমাদের’) ঘর উড়ে গেছে।
৭. কাছে-দূরে কী ছড়ানো আছে?
উত্তর: কাছে-দূরে শিশুদের শব ছড়ানো আছে।
৮. কবির মতে আমাদের কী নেই?
উত্তর: কবির মতে আমাদের কোনো পথ বা ইতিহাস নেই।
৯. “আমরাও তবে এইভাবে” – ‘এইভাবে’ বলতে কীভাবে বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘এইভাবে’ বলতে শিশুদের শবের মতো অসহায়ভাবে মৃত্যুর কথা বোঝানো হয়েছে।
১০. কবি কী করতে আহ্বান জানিয়েছেন?
উত্তর: কবি হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে থাকতে অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
১১. “আমাদের ইতিহাস নেই” – কেন এ কথা বলা হয়েছে?
উত্তর: কারণ সাধারণ, প্রান্তিক মানুষের কথা প্রচলিত ইতিহাসে লেখা হয় না, তাই এ কথা বলা হয়েছে।
১২. আমাদের চোখ-মুখ কীসে ঢাকা?
উত্তর: আমাদের চোখ-মুখ বিকৃত বা চাপা দেওয়া ইতিহাসে ঢাকা।
১৩. পৃথিবী সম্পর্কে কবির মনে কী সংশয় জেগেছে?
উত্তর: পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে অথবা মরে গেছে—এই সংশয় কবির মনে জেগেছে।
১৪. ‘বেঁধে বেঁধে থাকি’ কথাটির অর্থ কী?
উত্তর: ‘বেঁধে বেঁধে থাকি’ কথাটির অর্থ হলো সংঘবদ্ধভাবে বা একে অপরের সঙ্গে unido হয়ে থাকি।
১৫. আমরা কত মাস ভিখারি?
উত্তর: আমরা বারো মাস ভিখারি।
১৬. “আমাদের কথা কে-বা জানে” – এই উক্তির কারণ কী?
উত্তর: সাধারণ মানুষ উপেক্ষিত এবং তাদের অস্তিত্বের সংকট এত তীব্র যে, তাদের কথা কেউ জানে না বা জানার চেষ্টা করে না।
১৭. ‘ধস’ শব্দটি কোন অর্থ বহন করে?
উত্তর: ‘ধস’ শব্দটি সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের অর্থ বহন করে।
১৮. ‘গিরিখাদ’ শব্দটি কীসের প্রতীক?
উত্তর: ‘গিরিখাদ’ শব্দটি ভয়ংকর বিপদ বা পতনের প্রতীক।
১৯. কবিতায় কোন প্রশ্নটি দুবার করা হয়েছে?
উত্তর: “আমরাও তবে এইভাবে / এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?” – এই প্রশ্নটি কবিতায় দুবার করা হয়েছে।
২০. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ – এই আহ্বান কাদের প্রতি?
উত্তর: এই আহ্বান বিপন্ন, অসহায়, অস্তিত্বের সংকটে ভোগা সমস্ত সাধারণ মানুষের প্রতি।
২১. “আমাদের পথ নেই আর” – ‘আর’ শব্দটি কী অর্থে ব্যবহৃত?
উত্তর: ‘আর’ শব্দটি ‘এখন’ বা ‘এই মুহূর্তে’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা চরম সংকটকে নির্দেশ করে।
২২. কবিতাটির মূল ভাব কী?
উত্তর: কবিতাটির মূল ভাব হলো, চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে একমাত্র ঐক্যবদ্ধভাবেই অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব।
২৩. “ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে” – কী ছড়ানো রয়েছে?
উত্তর: কাছে-দূরে শিশুদের মৃতদেহ বা শব ছড়ানো রয়েছে।
২৪. কবি কোন পরিস্থিতিতে এই কবিতা লিখেছেন?
উত্তর: কবি এক সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অস্থির, সংকটময় পরিস্থিতিতে এই কবিতা লিখেছেন।
২৫. ‘আমরা’ কারা?
উত্তর: ‘আমরা’ বলতে কবি নিজের সহ বিপন্ন, অসহায়, সাধারণ মানুষদের বুঝিয়েছেন।
২৬. কবিতায় বর্ণিত বিপদগুলি কী কী?
উত্তর: কবিতায় বর্ণিত বিপদগুলি হলো—ডানদিকে ধস, বাঁদিকে গিরিখাদ, মাথায় বোমারু এবং পায়ে হিমানীর বাঁধ।
২৭. ‘চোখ-মুখ ঢাকা’ কেন?
উত্তর: বিকৃত ইতিহাস আমাদের আসল পরিচয়কে ঢেকে রেখেছে বলে আমাদের চোখ-মুখ ঢাকা।
২৮. “আমরা ফিরেছি দোরে দোরে” – এই পঙক্তিটির অর্থ কী?
উত্তর: এই পঙক্তিটির অর্থ হলো, আমরা সর্বস্ব হারিয়ে আশ্রয়ের জন্য বা বাঁচার তাগিদে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি।
২৯. কবিতায় কবি কীসের অভাব বোধ করেছেন?
উত্তর: কবিতায় কবি সঠিক পথ এবং সঠিক ইতিহাসের অভাব বোধ করেছেন।
৩০. ‘হাতে হাত রাখা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘হাতে হাত রাখা’ বলতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংহতিকে বোঝানো হয়েছে।
৩১. কবিতার একমাত্র আশার আলো কী?
উত্তর: কবিতার একমাত্র আশার আলো হলো ঐক্যবদ্ধভাবে বা ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকা।
৩২. ‘শিশুদের শব’ কাদের প্রতীক?
উত্তর: ‘শিশুদের শব’ হলো নিষ্পাপ প্রাণের বলিদান এবং ভবিষ্যতের ধ্বংসের প্রতীক।
৩৩. ‘ঘর গেছে উড়ে’ – এর অর্থ কী?
উত্তর: ‘ঘর গেছে উড়ে’ – এর অর্থ হলো আশ্রয় বা ঠিকানা হারানো, বাস্তুচ্যুত হওয়া।
৩৪. কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি কোন সময়ের কথা বলেছেন?
উত্তর: কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি এক ক্রান্তিকাল বা সংকটময় সময়ের কথা বলেছেন।
৩৫. ‘হিমানী’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ‘হিমানী’ শব্দের অর্থ হলো বরফের স্তূপ বা হিমবাহ।
৩৬. কবি কেমন ইতিহাসে বিশ্বাসী নন?
উত্তর: যে ইতিহাস সাধারণ মানুষের কথা বলে না এবং চোখ-মুখ ঢেকে রাখে, কবি তেমন ইতিহাসে বিশ্বাসী নন।
৩৭. শঙ্খ ঘোষের একটি বিখ্যাত গদ্যগ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর: শঙ্খ ঘোষের একটি বিখ্যাত গদ্যগ্রন্থ হলো ‘শব্দ আর সত্য’।
৩৮. কবিতাটিতে কোন ಭಾವনা প্রধান?
উত্তর: কবিতাটিতে অস্তিত্বের সংকট এবং তা থেকে উত্তরণের জন্য ঐক্যের ভাবনা প্রধান।
৩৯. “এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?” – এই প্রশ্ন কেন জেগেছে?
উত্তর: চারিদিকে বিপদ ও ধ্বংসের ছবি দেখে নিজেদের অসহায় অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে এই প্রশ্ন জেগেছে।
৪০. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ – এই আহ্বান কাদের জন্য জরুরি?
উত্তর: এই আহ্বান সেই সব অসহায়, বিপন্ন মানুষদের জন্য জরুরি, যাদের কোনো পথ নেই, ইতিহাস নেই।
গ) সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলী – মান ৩ (২৫টি)
১. “আমাদের ডান পাশে ধস/আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ” – পঙক্তি দুটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর: এই পঙক্তি দুটির মাধ্যমে কবি এক চরম সংকটময় পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছেন। ‘ডান পাশে ধস’ বলতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক অবক্ষয়কে বোঝানো হয়েছে। ‘বাঁয়ে গিরিখাদ’ বলতে বোঝানো হয়েছে ভয়ংকর বিপদ বা পতনের আশঙ্কা। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষ এমন এক বিপজ্জনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে একদিকে অবক্ষয় এবং অন্যদিকে পতন—কোনো দিকেই যাওয়ার পথ নেই।
২. “আমাদের মাথায় বোমারু/পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ” – এই চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর: এই চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি মানুষের চতুর্দিকের বিপদকে তুলে ধরেছেন। ‘মাথায় বোমারু’ বলতে উপর থেকে আসা আক্রমণ অর্থাৎ যুদ্ধ বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়কে বোঝানো হয়েছে। ‘পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ’ বলতে অগ্রগতির পথে জমাট বাঁধা প্রতিবন্ধকতা বা স্থবিরতাকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, মানুষ উপর থেকে আক্রান্ত এবং নিচেও তার চলার পথ রুদ্ধ।
৩. “আমাদের ইতিহাস নেই” – কেন কবি এমন মন্তব্য করেছেন?
উত্তর: কবি শঙ্খ ঘোষ এই উক্তির মাধ্যমে সাধারণ, প্রান্তিক মানুষদের কণ্ঠহীনতার কথা বলেছেন। প্রচলিত ইতিহাস সাধারণত রাজা-মহারাজা বা ক্ষমতাবানদের কাহিনী লেখে। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম, বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার কথা সেই ইতিহাসে স্থান পায় না। তাই কবি বলেছেন, সর্বহারা, অসহায় মানুষদের কোনো স্বীকৃত ইতিহাস নেই, তারা ইতিহাসে উপেক্ষিত।
৪. “পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে/পৃথিবী হয়তো গেছে মরে” – এই দ্বিধার কারণ কী?
উত্তর: কবির এই দ্বিধার কারণ হলো, তিনি যে জগতে বাস করছেন, সেখানে মানবিকতা, ভালোবাসা, শিশুর নিরাপত্তা—কিছুই নেই। চারিদিকে শুধু ধ্বংস আর মৃত্যু। তাই তাঁর মনে হয়েছে, भौतिकভাবে পৃথিবী টিকে থাকলেও তার আত্মা বা মানবিক সত্তা হয়তো মরে গেছে। এই সংশয় ও অনিশ্চয়তাবোধ থেকেই কবির মনে এই দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
৫. “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” – কবি কেন বারবার এই আহ্বান জানিয়েছেন?
উত্তর: কবি দেখেছেন, সাধারণ মানুষ আজ চতুর্দিক থেকে বিপন্ন। তাদের আশ্রয় নেই, পথ নেই, এমনকি ইতিহাসেও তাদের কোনো স্থান নেই। এই চরম অস্তিত্বের সংকটের মুহূর্তে কবি বুঝতে পেরেছেন যে, একা একা বিচ্ছিন্নভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। একমাত্র উপায় হলো সংঘবদ্ধ হওয়া, একে অপরের পাশে দাঁড়ানো। তাই এই সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে তিনি বারবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
৬. “আমাদের ঘর গেছে উড়ে” – ‘ঘর’ কীসের প্রতীক? ‘উড়ে যাওয়া’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: এখানে ‘ঘর’ শুধুমাত্র একটি বাসস্থান নয়, এটি আশ্রয়, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার প্রতীক। ‘উড়ে যাওয়া’ বলতে বোঝানো হয়েছে যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাধারণ মানুষের আশ্রয় ও নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা আজ বাস্তুচ্যুত, সহায়-সম্বলহীন। এই পঙক্তিটি মানুষের আশ্রয়হীনতার গভীর সংকটকে প্রকাশ করে।
৭. “শিশুদের শব/ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে” – এই পঙক্তিটির মর্মান্তিকতা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর: এই পঙক্তিটি কবিতার সবচেয়ে মর্মান্তিক চিত্রকল্প। শিশুরা হলো নিষ্পাপ, সারল্য এবং ভবিষ্যতের প্রতীক। তাদের মৃতদেহ কাছে-দূরে ছড়িয়ে থাকার অর্থ হলো, যে সংকটময় পরিস্থিতিতে আমরা বাস করছি, সেখানে নিষ্পাপ প্রাণেরও কোনো নিরাপত্তা নেই। এটি শুধু শিশুর মৃত্যু নয়, এটি ভবিষ্যতের মৃত্যু। এই দৃশ্য যুদ্ধের বা সন্ত্রাসের ভয়াবহতম রূপটিকে প্রকাশ করে।
৮. “আমরাও তবে এইভাবে/এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?” – এই প্রশ্নের মাধ্যমে বক্তার কোন মানসিক অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে?
উত্তর: এই প্রশ্নের মাধ্যমে বক্তার চরম ভয়, নিরাপত্তাহীনতা এবং অস্তিত্বের সংকট ফুটে উঠেছে। যখন তিনি দেখেন যে, নিষ্পাপ শিশুরাও রক্ষা পাচ্ছে না, তাদের মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে, তখন তিনি নিজের এবং তার মতো সাধারণ মানুষদের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। এই প্রশ্নটি তাদের অসহায়ত্ব এবং আসন্ন মৃত্যুর ভয়কে তীব্রভাবে প্রকাশ করে।
৯. “আমাদের পথ নেই আর” – পথ না থাকার কারণ কী?
উত্তর: ‘পথ নেই’ কথাটির অর্থ হলো, এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় বা দিশা নেই। সাধারণ মানুষ এতটাই বিপদে পড়েছে যে, তারা জানে না কোন দিকে গেলে মুক্তি পাবে। ডানদিকে অবক্ষয়, বাঁদিকে পতন, মাথার উপর আক্রমণ—এই চতুর্মুখী বিপদের কারণে তাদের সামনে কোনো মুক্তির পথ খোলা নেই।
১০. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় ‘আমরা’ কারা? তাদের পরিস্থিতি কেমন?
উত্তর: এই কবিতায় ‘আমরা’ বলতে কবি নিজের সহ সমস্ত বিপন্ন, অসহায়, সাধারণ মানুষকে বুঝিয়েছেন। তাদের পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটময়। তারা চতুর্দিক থেকে বিপদ দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে, শিশুরা মৃত, এবং তাদের অগ্রগতির পথও রুদ্ধ। তারা ইতিহাস থেকে উপেক্ষিত এবং নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান।
১১. “আমাদের চোখ মুখ ঢাকা” – কী দিয়ে এবং কেন চোখ মুখ ঢাকা?
উত্তর: আমাদের চোখ-মুখ বিকৃত ইতিহাস দিয়ে ঢাকা। কবি বলতে চেয়েছেন, যে ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়, তা সত্য নয়। সেই ইতিহাস সাধারণ মানুষের আসল পরিচয়, তাদের সংগ্রাম ও যন্ত্রণাকে আড়াল করে রাখে। এই বিকৃত ইতিহাসই আমাদের চোখ ও মুখ, অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টি ও কণ্ঠকে ঢেকে রেখেছে, যার ফলে আমরা নিজেদের আসল পরিচয় জানতে পারি না।
১২. ‘ভিখারি বারো মাস’ – এই উক্তির তাৎপর্য কী?
উত্তর: এই উক্তির মাধ্যমে কবি সাধারণ মানুষের চরম সর্বহারা অবস্থাকে বুঝিয়েছেন। ‘ভিখারি’ মানে শুধু যারা ভিক্ষা করে তারা নয়, এখানে ভিখারি বলতে বোঝানো হয়েছে যাদের আশ্রয়, নিরাপত্তা, অধিকার—সবকিছুই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ‘বারো মাস’ শব্দটি এই অবস্থাকে চিরস্থায়ী বা সার্বক্ষণিক বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষ সারাবছরই সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় দিন কাটায়।
১৩. “আয় আরো হাতে হাত রেখে” – এই আহ্বানের গুরুত্ব কী?
উত্তর: এই আহ্বানের গুরুত্ব অপরিসীম। ‘হাতে হাত রাখা’ হলো পারস্পরিক বিশ্বাস, সহযোগিতা এবং সংহতির প্রতীক। কবি মনে করেন, এই চরম সংকটের মুহূর্তে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও সহযোগিতা ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তিই পারে সমস্ত বিপদকে মোকাবিলা করতে। তাই এই আহ্বান হলো অস্তিত্ব রক্ষার মূল মন্ত্র।
১৪. কবিতার প্রেক্ষাপটে ‘ইতিহাস’-এর ভূমিকা কী?
উত্তর: কবিতায় ‘ইতিহাস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কবির মতে, সাধারণ মানুষের কোনো নিজস্ব ইতিহাস নেই, কারণ প্রচলিত ইতিহাসে তাদের স্থান হয় না। যে ইতিহাস আছে, তা বিকৃত এবং তা আমাদের আসল পরিচয়কে ঢেকে রাখে। এই ইতিহাসহীনতা সাধারণ মানুষকে পরিচয় সংকটে ফেলে দেয়। তাই কবি ইতিহাস নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
১৫. কবিতাটির মূল বক্তব্য নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর: ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার মূল বক্তব্য হলো, এক চরম সংকটময় ও বিপন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। কবি দেখিয়েছেন যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়, যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসের কারণে সাধারণ মানুষের জীবন আজ বিপন্ন। এই পরিস্থিতিতে বাঁচার একমাত্র পথ হলো সমস্ত বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। পারস্পরিক সংহতি ও ভালোবাসাই পারে এই ভয়াবহ সংকট থেকে মানুষকে রক্ষা করতে।
১৬. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ – ‘আরো’ শব্দটি কেন ব্যবহৃত হয়েছে?
উত্তর: ‘আরো’ শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে, আমরা হয়তো কিছুটা একতাবদ্ধ আছি, কিন্তু বর্তমান সংকট এতটাই তীব্র যে, তা যথেষ্ট নয়। আমাদের আরও বেশি করে, আরও দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই শব্দটি ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার গভীরতা ও তীব্রতাকে নির্দেশ করে।
১৭. “আমাদের কথা কে-বা জানে/আমরা ফিরেছি দোরে দোরে” – এই পঙক্তি দুটির মধ্যেকার সম্পর্ক কী?
উত্তর: এই পঙক্তি দুটির মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। যেহেতু সাধারণ মানুষের কথা কেউ জানে না, তারা ইতিহাসে ও সমাজে উপেক্ষিত এবং গুরুত্বহীন, তাই তাদের কোনো স্থায়ী আশ্রয় বা ঠিকানা নেই। এই পরিচয়হীনতা ও গুরুত্বহীনতার কারণেই তারা সর্বহারা হয়ে আশ্রয়ের জন্য বা বাঁচার তাগিদে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে বাধ্য হয়েছে।
১৮. কবিতাটিতে যে সংকটময় পরিস্থিতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা বর্তমান সময়ে কতটা প্রাসঙ্গিক?
উত্তর: কবিতাটিতে বর্ণিত সংকটময় পরিস্থিতি বর্তমান সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আজও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক অবক্ষয় চলছে। সাধারণ মানুষ আজও বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, শিশুরা মারা যাচ্ছে এবং মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে কবির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান আজও সমানভাবে জরুরি ও প্রাসঙ্গিক।
১৯. ‘ধস’ ও ‘গিরিখাদ’ – এই দুটি প্রাকৃতিক রূপককে কবি কীভাবে সামাজিক অবক্ষয় বোঝাতে ব্যবহার করেছেন?
উত্তর: ‘ধস’ যেমন পাহাড়কে ভেঙে ফেলে, তেমনই সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়। ‘গিরিখাদ’ যেমন এক অতল গহ্বর, তেমনই সমাজের মধ্যেকার বিভেদ, হিংসা ও অविश्वास মানুষকে এক ভয়ংকর পতনের দিকে ঠেলে দেয়। কবি এই দুটি প্রাকৃতিক রূপকের মাধ্যমে অত্যন্ত সার্থকভাবে সমাজের এই গভীর সংকটকে তুলে ধরেছেন।
২০. কবিতাটিতে ‘আমাদের’ শব্দটি বারবার ব্যবহারের কারণ কী?
উত্তর: ‘আমাদের’ শব্দটি বারবার ব্যবহারের মাধ্যমে কবি বুঝিয়েছেন যে, এই সংকট কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়, এটি একটি সমষ্টিগত সংকট। তিনি নিজেকে সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা করেননি, বরং তাদেরই একজন হিসেবে দেখেছেন। এই শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে কবি এক ধরনের সমষ্টিগত চেতনা বা ‘Collective Consciousness’ তৈরি করতে চেয়েছেন, যা ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করে।
২১. “অথবা এমনই ইতিহাস” – ‘এমনই ইতিহাস’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর: ‘এমনই ইতিহাস’ বলতে কবি সেই বিকৃত বা খণ্ডিত ইতিহাসকে বুঝিয়েছেন, যা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়। এই ইতিহাস সত্যকে আড়াল করে এবং মানুষের আসল পরিচয়কে ঢেকে রাখে। এটি ক্ষমতাবানদের দ্বারা নির্মিত ইতিহাস, যেখানে সাধারণ মানুষের কোনো স্থান নেই। এই ইতিহাস আমাদের অন্ধ করে রাখে।
২২. ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকার প্রয়োজনীয়তা কবি কীভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন?
উত্তর: কবি প্রথমে চতুর্দিকের বিপদের (ধস, গিরিখাদ, বোমারু) এবং অসহায়তার (ঘর নেই, পথ নেই, ইতিহাস নেই) এক সম্পূর্ণ চিত্র তুলে ধরেছেন। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, একা একা বাঁচার কোনো উপায় নেই। এই প্রেক্ষাপট তৈরি করার পরেই তিনি সমাধান হিসেবে ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, যা পাঠকের কাছে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়।
২৩. “আমাদের যা বলার ছিল” – কী বলার ছিল বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর: আমাদের যা বলার ছিল তা হলো আমাদের নিজেদের কথা, নিজেদের ইতিহাস, আমাদের যন্ত্রণা ও সংগ্রামের কাহিনী। কিন্তু সেই কথা বলার সুযোগ বা মাধ্যম আমাদের নেই। আমাদের কণ্ঠস্বরকে চাপা দেওয়া হয়েছে। আমাদের বলার ছিল প্রতিবাদের কথা, কিন্তু সেই শক্তিও হয়তো আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
২৪. কবিতাটিতে কোনো আশার সুর আছে কি? থাকলে সেটি কী?
উত্তর: কবিতাটির সামগ্রিক প্রেক্ষাপট হতাশাব্যঞ্জক হলেও, এর মধ্যে একটি দৃঢ় আশার সুর রয়েছে। সেই আশা হলো ঐক্যের শক্তি। “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” – এই আহ্বানটিই হলো সেই আশার সুর। কবি বিশ্বাস করেন, সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যদি আমরা সংঘবদ্ধ হতে পারি, তবে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
২৫. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ – এই শিরোনামের মধ্যে ‘আয়’ শব্দটি কীসের দ্যোতক?
উত্তর: ‘আয়’ শব্দটি এখানে একটি আন্তরিক আহ্বানের দ্যোতক। এটি কোনো আদেশ নয়, বরং এক বন্ধুর প্রতি আরেক বন্ধুর, এক অসহায় মানুষের প্রতি আরেক অসহায় মানুষের আকুল আবেদন। এই শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে কবি তাঁর আহ্বানের মধ্যে এক ধরনের সমব্যথী ও মানবিক আবেদন যুক্ত করেছেন, যা পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে।
ঘ) রচনাধর্মী প্রশ্নাবলী – মান ৫ (১০টি)
১. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার নামকরণের সার্থকতা বিচার করো।
উত্তর:
ভূমিকা: যেকোনো সাহিত্যের নামকরণ তার বিষয়বস্তু, মূল ভাব এবং কবির অভিপ্রায়কে ধারণ করে। শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটির নামকরণ এই নিরিখে এক অনবদ্য সৃষ্টি এবং সর্বাংশে সার্থক।
কবিতার প্রেক্ষাপট: কবিতাটি এক চরম সংকটময় সময়ের ছবি তুলে ধরে। কবি দেখিয়েছেন, সাধারণ মানুষ আজ চতুর্দিক থেকে বিপন্ন—তাদের ডানদিকে সামাজিক অবক্ষয়ের ‘ধস’, বাঁদিকে সর্বনাশা ‘গিরিখাদ’, মাথার উপর যুদ্ধের ‘বোমারু’ এবং চলার পথে অগ্রগতির প্রতিবন্ধক ‘হিমানীর বাঁধ’। তাদের আশ্রয় নেই (“ঘর গেছে উড়ে”), ভবিষ্যৎ অন্ধকার (“শিশুদের শব”) এবং কোনো মুক্তির পথও জানা নেই (“আমাদের পথ নেই কোনো”)।
নামকরণের প্রাসঙ্গিকতা: এই ভয়াবহ ও হতাশাজনক পরিস্থিতিতে কবি একমাত্র সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছেন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মধ্যে। ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’—এই পঙক্তিটি শুধুমাত্র কবিতার একটি লাইন নয়, এটি কবির মূল বক্তব্য ও আহ্বান। ‘আয়’ শব্দটি এক আন্তরিক আবেদন, ‘আরো’ শব্দটি ঐক্যের গভীরতার প্রয়োজনীয়তা এবং ‘বেঁধে বেঁধে থাকি’ কথাটি সংঘবদ্ধভাবে অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায়কে নির্দেশ করে।
উপসংহার: যেহেতু কবিতাটির সমস্ত হতাশা ও সংকটের বর্ণনারচূড়ান্ত পরিণতি হলো এই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানের মধ্যে, তাই এই নামকরণটিই কবিতার মূল সুর, বার্তা এবং সমাধানকে একত্রে ধারণ করেছে। তাই, ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ নামকরণটি অত্যন্ত ব্যঞ্জনাময় ও সার্থক।
২. “আমাদের পথ নেই কোনো” – ‘আমাদের’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে? তাদের পথ না থাকার কারণ কী? এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কবি কী উপায় নির্দেশ করেছেন?
উত্তর:
‘আমাদের’ পরিচয়: ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় ‘আমাদের’ বলতে কবি কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে বোঝাননি। এখানে ‘আমাদের’ হলো এক বিপন্ন মানবজাতির প্রতিনিধি—সেই সব সাধারণ, অসহায়, প্রান্তিক মানুষ, যারা যুগ যুগ ধরে সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় হিংসার শিকার। কবি নিজেকেও এই বিপন্ন সমষ্টির অংশ হিসেবেই দেখেছেন।
পথ না থাকার কারণ: তাদের পথ না থাকার একাধিক কারণ কবিতায় উল্লিখিত হয়েছে—
১. চতুর্মুখী বিপদ: তারা এমন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ডানদিকে অবক্ষয়ের ধস এবং বাঁদিকে পতনের গিরিখাদ। মাথার উপর যুদ্ধের আশঙ্কা এবং পায়ের নিচে স্থবিরতার প্রতিবন্ধকতা। এই চতুর্মুখী বিপদের কারণে তাদের সামনে কোনো নিরাপদ পথ খোলা নেই।
২. আশ্রয়হীনতা ও ইতিহাসহীনতা: তাদের আশ্রয় (“ঘর”) কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম (“শিশু”) বিপন্ন। তাদের কোনো সঠিক ইতিহাস নেই, যা থেকে তারা প্রেরণা বা পথের দিশা পেতে পারে। এই পরিচয়হীনতা ও দিশাহীনতাই তাদের পথহীন করে তুলেছে।
উত্তরণের উপায়: এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হিসেবে কবি সংঘবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, যদি এই অসহায় মানুষগুলো হাতে হাত রেখে, ‘বেঁধে বেঁধে’ অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধভাবে থাকতে পারে, তবেই এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। পারস্পরিক সংহতিই হলো তাদের একমাত্র পথ।
৩. “আমাদের ইতিহাস নেই/অথবা এমনই ইতিহাস/আমাদের চোখ মুখ ঢাকা” – এই পঙক্তিগুলির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তর:
ভূমিকা: শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার এই পঙক্তিগুলি সাধারণ মানুষের আত্মপরিচয়ের সংকট এবং ইতিহাস নিয়ে এক গভীর প্রশ্ন তুলে ধরে।
“আমাদের ইতিহাস নেই”: এই উক্তির মাধ্যমে কবি বলতে চেয়েছেন যে, প্রচলিত ইতিহাসে সাধারণ, প্রান্তিক মানুষদের কোনো স্থান নেই। ইতিহাস লেখে বিজয়ী এবং ক্ষমতাবানরা। সেখানে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রাম, তাদের আনন্দ-বেদনা, বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়ার কাহিনী উপেক্ষিত থেকে যায়। তাই, তাদের কাছে নিজেদের কোনো গৌরবময় বা স্বীকৃত ইতিহাস নেই।
“অথবা এমনই ইতিহাস/আমাদের চোখ মুখ ঢাকা”: এই অংশে কবি এক বিকল্প সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তিনি বলছেন, হয়তো আমাদের ইতিহাস আছে, কিন্তু সেই ইতিহাস এতটাই বিকৃত বা খণ্ডিতভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে যে, তা আমাদের আসল পরিচয়কে চিনতে দেয় না, বরং ঢেকে রাখে। ‘চোখ মুখ ঢাকা’ কথাটির অর্থ হলো, এই বিকৃত ইতিহাস আমাদের দৃষ্টিকে (চোখ) আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং আমাদের প্রতিবাদের ভাষাকে (মুখ) কেড়ে নিয়েছে। আমরা নিজেদের সত্য পরিচয় জানতে পারি না এবং তার সম্পর্কে কথা বলতেও পারি না।
উপসংহার: সুতরাং, এই পঙক্তিগুলির মাধ্যমে কবি সাধারণ মানুষের ইতিহাসহীনতা এবং পরিচয়হীনতার গভীর যন্ত্রণা ও সংকটকে তুলে ধরেছেন, যা তাদের অসহায়ত্বকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
৪. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় ফুটে ওঠা সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের চিত্রটি নিজের ভাষায় বর্ণনা করো।
উত্তর:
ভূমিকা: শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি কোনো নির্দিষ্ট সময়ের কথা বললেও, এর আবেদন সার্বজনীন। কবিতাটিতে এক অস্থির ও সংকটময় সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
রাজনৈতিক সংকট: কবিতার “মাথায় বোমারু” চিত্রকল্পটি সরাসরি যুদ্ধ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বা সামরিক আগ্রাসনের ইঙ্গিত দেয়। এটি এমন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। রাষ্ট্র তাদের রক্ষা করার পরিবর্তে তাদের উপর আক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। “শিশুদের শব” এই রাজনৈতিক হিংসারই ভয়াবহতম পরিণতি।
সামাজিক সংকট: “ডান পাশে ধস” এবং “বাঁয়ে গিরিখাদ” চিত্রকল্প দুটি সামাজিক অবক্ষয় ও পতনের প্রতীক। সমাজে যখন নৈতিকতা, মূল্যবোধ ভেঙে পড়ে, তখন তাকে ‘ধস’ বলা যেতে পারে। অন্যদিকে, বিভেদ, হিংসা ও অবিশ্বাসের কারণে সমাজ পতনের গভীরে তলিয়ে যায়, যা ‘গিরিখাদ’-এর প্রতীক। “ঘর গেছে উড়ে” কথাটি সামাজিক অস্থিরতার কারণে মানুষের আশ্রয়হীনতা ও বাস্তুচ্যুতিকে নির্দেশ করে। “আমরা ভিখারি বারো মাস” উক্তিটি সমাজের চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সাধারণ মানুষের সর্বহারা অবস্থাকে তুলে ধরে।
উপসংহার: এভাবেই, কবিতাটি যুদ্ধ, সন্ত্রাস, সামাজিক অবক্ষয়, আশ্রয়হীনতা এবং পরিচয়হীনতার মতো নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের এক বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে, যা যেকোনো সময়ের পাঠকের কাছে প্রাসঙ্গিক।
৫. “পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে/পৃথিবী হয়তো গেছে মরে” – এই পঙক্তিটির অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা বিশ্লেষণ করো।
উত্তর:
ভূমিকা: ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার এই পঙক্তিটি কবির গভীর সংশয়, হতাশা এবং এক জটিল দার্শনিক চিন্তার প্রকাশ। এটি কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লাইন।
অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা:
১. বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সত্তার দ্বন্দ্ব: “পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে” – এই কথাটির মাধ্যমে কবি পৃথিবীর বাহ্যিক বা भौतिक অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন। গাছপালা, নদী-নালা, ভৌগোলিক কাঠামো হয়তো এখনও টিকে আছে। কিন্তু “পৃথিবী হয়তো গেছে মরে” – এই উক্তির মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ বা আত্মিক সত্তার মৃত্যুর কথা বলেছেন।
২. মানবিকতার অবক্ষয়: কবির মতে, একটি পৃথিবী শুধুমাত্র তার ভৌগোলিক অস্তিত্ব দিয়ে বেঁচে থাকে না। তার প্রাণ হলো মানবিকতা, ভালোবাসা, দয়া, করুণা এবং শিশুর নিরাপত্তা। যখন সমাজে যুদ্ধ, হিংসা, অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে, শিশুরা খুন হয়, তখন পৃথিবীর সেই মানবিক আত্মা মরে যায়।
৩. গভীর সংশয় ও অনিশ্চয়তা: ‘হয়তো’ শব্দটি কবির গভীর সংশয়কে প্রকাশ করে। তিনি এতটাই হতাশ ও বিভ্রান্ত যে, তিনি পৃথিবীর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কেই নিশ্চিত নন। তাঁর কাছে বেঁচে থাকা এবং মরে যাওয়া প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। এই লাইন দুটি আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের সংকট এবং চরম মূল্যবোধের অবক্ষয়কে তুলে ধরে।
উপসংহার: সুতরাং, এই পঙক্তিটি শুধুমাত্র একটি দ্বিধা নয়, এটি একবিংশ শতাব্দীর মানুষের এক গভীর নৈতিক ও দার্শনিক সংকটের শৈল্পিক প্রকাশ।
৬. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় কবি যে বিপন্নতার ছবি এঁকেছেন, তা আলোচনা করো। এই বিপন্নতা থেকে মুক্তির কী উপায় তিনি নির্দেশ করেছেন?
উত্তর:
ভূমিকা: শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি মূলত এক গভীর বিপন্নতার দলিল। কবি নানা চিত্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের অসহায় ও সংকটময় অবস্থাকে তুলে ধরেছেন।
বিপন্নতার চিত্র:
১. অস্তিত্বের সংকট: মানুষ এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে একদিকে ‘ধস’ (অবক্ষয়) এবং অন্যদিকে ‘গিরিখাদ’ (পতন)। মাথার উপর ‘বোমারু’ (যুদ্ধ) এবং পায়ের নিচে ‘হিমানীর বাঁধ’ (স্থবিরতা)। এই চতুর্মুখী বিপদ তাদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে।
২. আশ্রয়হীনতা: তাদের ‘ঘর গেছে উড়ে’, অর্থাৎ তারা বাস্তুচ্যুত ও আশ্রয়হীন।
৩. ভবিষ্যতের বিনাশ: ‘শিশুদের শব’ ছড়িয়ে থাকার দৃশ্য প্রমাণ করে যে, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও নিরাপদ নয়।
৪. পরিচয়হীনতা: তাদের কোনো সঠিক ‘পথ’ বা ‘ইতিহাস’ নেই। তারা সমাজে উপেক্ষিত এবং নিজেদের পরিচয় নিয়েই সংকটে।
মুক্তির উপায়: এই সর্বগ্রাসী বিপন্নতা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হিসেবে কবি সংঘবদ্ধতার কথা বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এই চরম দুর্দিনে একা একা টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, “আয় আরো হাতে হাত রেখে/ আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি”। পারস্পরিক সংহতি, বিশ্বাস ও ঐক্যই হলো এই বিপন্নতা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ।
৭. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় ‘আমাদের’ শব্দটি একটি সমষ্টিগত সত্তার প্রতীক। এই সমষ্টির সংকট ও উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তর:
ভূমিকা: ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় ‘আমাদের’ শব্দটি শুধু কবি ও তাঁর সঙ্গীদের বোঝায় না, এটি এক বিপন্ন, অসহায় কিন্তু সংগ্রামী সমষ্টিগত সত্তার প্রতীক।
সংকট: এই সমষ্টির সংকট multifaceted।
১. বাহ্যিক সংকট: তারা যুদ্ধ (“বোমারু”), সামাজিক অবক্ষয় (“ধস”) এবং পতনের (“গিরিখাদ”) মতো বাহ্যিক বিপদের শিকার। তাদের আশ্রয় (“ঘর”) কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
২. আভ্যন্তরীণ সংকট: তাদের কোনো সঠিক পথ বা দিশা জানা নেই (“আমাদের পথ নেই কোনো”)। তারা ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন এবং পরিচয়হীন (“আমাদের ইতিহাস নেই”)। এই সংকট তাদের মানসিকভাবেও দুর্বল করে দিয়েছে, যার ফলে তারা নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান (“এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?”)।
উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা: এই গভীর সংকটের মধ্যেও এই সমষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। কবি সেই আকাঙ্ক্ষাকেই ভাষা দিয়েছেন তাঁর আহ্বানের মাধ্যমে। “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” – এই পঙক্তিটি বিচ্ছিন্নতা থেকে ঐক্যের দিকে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। “হাতে হাত রেখে” চলার ইচ্ছা হলো পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতার মাধ্যমে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। কবি মনে করেন, এই সমষ্টিগত আকাঙ্ক্ষা ও প্রচেষ্টাই তাদের রক্ষা করতে পারে।
৮. কবিতার প্রথম স্তবক ও দ্বিতীয় স্তবকের ভাববস্তুর তুলনা করে কবির মূল বক্তব্যটি প্রতিষ্ঠা করো।
উত্তর:
ভূমিকা: ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি দুটি স্তবকে বিভক্ত। দুটি স্তবকেই কবির মূল বক্তব্য ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্যে এক গভীর যোগসূত্র রয়েছে।
প্রথম স্তবকের ভাববস্তু: প্রথম স্তবকে কবি মূলত বাহ্যিক সংকটগুলির উপর আলোকপাত করেছেন। ডান পাশে ‘ধস’, বাঁয়ে ‘গিরিখাদ’, মাথায় ‘বোমারু’ এবং পায়ে ‘হিমানীর বাঁধ’—এই চিত্রকল্পগুলির মাধ্যমে কবি এক চতুর্মুখী বিপদের ছবি এঁকেছেন। এই স্তবকে সংকটটি মূলত भौतिक ও রাজনৈতিক। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ ফল হিসেবেই তাদের ‘ঘর গেছে উড়ে’ এবং ‘শিশুদের শব’ ছড়িয়ে আছে।
দ্বিতীয় স্তবকের ভাববস্তু: দ্বিতীয় স্তবকে কবি বাহ্যিক সংকট থেকে সরে এসে আভ্যন্তরীণ বা অস্তিত্বের সংকটের কথা বলেছেন। এখানে তিনি পথহীনতা (“আমাদের পথ নেই কোনো”), ইতিহাসহীনতা (“আমাদের ইতিহাস নেই”) এবং পরিচয়হীনতার (“আমাদের চোখ মুখ ঢাকা”) কথা বলেছেন। এই সংকট আরও গভীর ও মনস্তাত্ত্বিক। এই স্তবকে পৃথিবী সম্পর্কেই কবির মনে সংশয় জেগেছে।
মূল বক্তব্য প্রতিষ্ঠা: দুটি স্তবক মিলিয়ে কবি একটি সম্পূর্ণ সংকটের ছবি তৈরি করেছেন। প্রথম স্তবক দেখায় ‘কেন’ আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে (বাহ্যিক বিপদের কারণে), আর দ্বিতীয় স্তবক দেখায় ‘কাদের’ ঐক্যবদ্ধ হতে হবে (যারা পথহীন, ইতিহাসহীন, পরিচয়হীন)। উভয় স্তবকের শেষে “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” এই পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে কবি প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ—উভয় সংকট থেকেই মুক্তির একমাত্র উপায় হলো সংঘবদ্ধ হওয়া।
৯. “আমাদের যা বলার ছিল/ চোখমুখ ঢাকা… আমাদের কথা কে-বা জানে” – এই লাইনগুলির মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের কণ্ঠরোধ এবং পরিচয়হীনতার যে ছবি ফুটে উঠেছে, তা বিশ্লেষণ করো।
উত্তর:
ভূমিকা: শঙ্খ ঘোষের এই কবিতাটি শুধু বিপন্নতার কথাই বলে না, এটি সাধারণ মানুষের কণ্ঠরোধ এবং পরিচয়হীনতার এক মর্মস্পর্শী দলিল।
কণ্ঠরোধের চিত্র: “আমাদের যা বলার ছিল” – এই অসমাপ্ত লাইনটিই এক গভীর শূন্যতা তৈরি করে। কবি বলতে চেয়েছেন, সাধারণ মানুষের অনেক না-বলা কথা, যন্ত্রণা, প্রতিবাদের ভাষা ছিল, কিন্তু তা বলার সুযোগ তারা পায়নি। “চোখমুখ ঢাকা” চিত্রকল্পটি এই কণ্ঠরোধের কারণকে স্পষ্ট করে। বিকৃত ইতিহাস বা ক্ষমতার চাপ তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে।
পরিচয়হীনতার চিত্র: “আমাদের কথা কে-বা জানে” – এই প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক গভীর অভিমান ও যন্ত্রণা। সমাজে বা ইতিহাসে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই, তাদের অস্তিত্ব প্রায় অদৃশ্য। তাই তাদের কথা বা কাহিনী কেউ জানে না, বা জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। “আমরা ফিরেছি দোরে দোরে” লাইনটি এই পরিচয়হীন ও আশ্রয়হীন অবস্থাকে আরও তীব্র করে তোলে।
উপসংহার: এভাবেই কবি দেখিয়েছেন যে, সাধারণ মানুষ শুধু भौतिक বিপদের শিকার নয়, তারা মানসিকভাবেও বিপন্ন। তাদের কণ্ঠ ও পরিচয় কেড়ে নিয়ে তাদের অস্তিত্বকেই সংকটের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিই কবিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানাতে বাধ্য করেছে।
১০. ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটিকে একটি রাজনৈতিক কবিতা বলা যায় কি? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও।
উত্তর:
ভূমিকা: হ্যাঁ, ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটিকে নিঃসন্দেহে একটি রাজনৈতিক কবিতা বলা যায়। তবে এটি কোনো সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির কবিতা নয়, এটি বিপন্ন মানবতার অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার রাজনীতি নিয়ে লেখা এক শক্তিশালী কবিতা।
যুক্তিসমূহ:
১. রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ইঙ্গিত: “মাথায় বোমারু” চিত্রকল্পটি সরাসরি রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বা যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়, যা একটি রাজনৈতিক বিষয়। রাষ্ট্র যখন নাগরিকদের রক্ষা না করে আক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা গভীর রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে।
২. ইতিহাসের রাজনীতি: “আমাদের ইতিহাস নেই” বা “এমনই ইতিহাস/আমাদের চোখ মুখ ঢাকা” – এই উক্তিগুলি ইতিহাসের রাজনীতির প্রতি ইঙ্গিত করে। ইতিহাস কীভাবে ক্ষমতাবানদের দ্বারা নির্মিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সাধারণ মানুষকে প্রান্তিক করে রাখে, সেই রাজনৈতিক সত্যটিই কবি তুলে ধরেছেন।
৩. সমষ্টিগত চেতনা: ‘আমাদের’ শব্দটি বারবার ব্যবহার করে কবি এক সমষ্টিগত রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দিয়েছেন। তিনি ব্যক্তিগত সংকটের পরিবর্তে একটি সমষ্টির সংকটের কথা বলেছেন, যা রাজনীতিরই অংশ।
৪. সমাধানের পথ: কবিতার শেষে “বেঁধে বেঁধে থাকি”র যে আহ্বান, তাও একটি রাজনৈতিক সমাধান। ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ বা সংহতি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
উপসংহার: যেহেতু কবিতাটি রাষ্ট্র, ক্ষমতা, ইতিহাস এবং সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং এক সমষ্টিগত সমাধানের কথা বলে, তাই একে একটি গভীর অর্থে রাজনৈতিক কবিতা বলাই যুক্তিযুক্ত।
Class 10 bengali আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি question answer
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি শঙ্খ ঘোষ কবিতার প্রশ্ন উত্তর, MCQ, অতি-সংক্ষিপ্ত, ও রচনাধর্মী প্রশ্ন উত্তর : Class 10 bengali আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি কবিতার প্রশ্ন উত্তর